শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৫ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশর বেশি দুধ সরাসরি পানের জন্য নিরাপদ নয়। বাণিজ্যিকভাবে গবেষণা করতে গিয়ে পাস্তুরিত দুধ সম্পর্কে এই ধরণের ফলাফল দেখতে পেয়েছেন আইসিডিডিআরবির গবেষকরা।
আইসিডিডিআরবির সহযোগী বিজ্ঞানী ও ফুড মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরির প্রধান ড. মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, শিশুদের পুষ্টির প্রাথমিক উৎস দুধ। বাজারের পাস্তুরিত কাঁচা দুধে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। তাই ভালোভাবে না ফুটিয়ে এসব দুধ কোনো অবস্থাতেই পান করা উচিত নয়। তবে ইউএইচটি দুধ থেকে সংগৃহীত নমুনায় জীবাণুর সংক্রমণ দেখা যায়নি। কাজেই সেগুলো পানের জন্য নিরাপদ।
তিনি বলেন, সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বাস্থ্যকরভাবে গরুর দুধ দোয়ানো, সংগ্রহ ও সরবরাহ, সংরক্ষণ এবং পাস্তুরিত করার বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। এছাড়াও পানের জন্য দুধকে নিরাপদ রাখতে দুধ উৎপাদনের স্থান থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে পাস্তুরিত দুধকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শীতল রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি।
আমিনুল ইসলাম বলেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেখে বুঝা যায় যে, দুধের পুষ্টিগত গুণাগুণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাথমিক উৎপদানকারী পর্যায়ে দুধ দূষণের সাথে গরুর প্রজনন প্রক্রিয়া, উৎপাদিত দুধের পরিমাণ, দুধ দোয়ানোর সময় এবং যিনি দোয়ান তার হাত ধোয়ার অভ্যাসের মতো বিষয়ও জড়িত।
তিনি বলেন, দুগ্ধ খামার থেকে শুরু করে বিক্রয়ের দোকান পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দুধ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়।
দুগ্ধ শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে দুধের অণুজীবিজ্ঞানগত মান যাচাই করার উদ্দেশ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের দুধ উৎপাদকারী, হিমাগার ও স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকে কাঁচা দুধের ৪৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও ঢাকা ও বগুড়ার বিভিন্ন দোকান থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত দুধের ৯৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
কেয়ার বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায় ‘স্ট্রেনদেনিং দ্য ডেইরি ভ্যালু চেইন (এসডিভিসি)’ প্রকল্পের আওতায় বগুড়া, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রংপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলার মোট ১৮টি উপজেলায় এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
বিজ্ঞানীরা দেখেন যে, প্রাথমিক দুধ উৎপাদনকারী পর্যায়ে ৭২ শতাংশ ও ৫৭ শতাংশ নমুনা যথাক্রমে কলিফর্ম (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) এবং ফিক্যাল কোলিফর্ম (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত এবং নমুনাসমূহের ১১ শতাংশ উচ্চসংখ্যক ই. কোলাই (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) দ্বারা দূষিত। ফিক্যাল কলিফর্র্ম ব্যাকটেরিয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং দুধে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির ফলে বোঝা যায় যে দুধ জীবাণু বা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা দূষিত, যা উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মলে থাকতে পারে বা দুধ দোয়ানোর সময় দুধে মিশতে পারে।
উৎপাদনকারীদের থেকে দুধ সংগ্রহের স্থানে দেখা যায়, নমুনাসমূহ উচ্চসংখ্যক কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) দ্বারা দূষিত এবং মল দ্বারা দূষিত হওয়ার হার ছিলো ৯১ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ নমুনায় উচ্চসংখ্যক ই. কোলাই ছিলো।
হিমাগারসমূহে সংগৃহীত নমুনাসমূহে দুধ সংগ্রহের স্থানের নমুনাসমূহের চেয়েও দূষণের হার বেশি দেখতে পাওয়া যায়। পাঁচটি জেলার ১৫টি হিমাগারে সংগৃহীত নমুনাসমূহে উচ্চসংখ্যক কলিফর্ম ও মলবাহিত কলিফর্ম পাওয়া যায়। সবগুলো হিমাগার থেকে সংগৃহীত নমুনায় ই. কোলাই পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা যায় ৬৭ শতাংশ নমুনা ই. কোলাই দ্বারা উচ্চমাত্রায় দূষিত। এছাড়াও বি. সেরেয়াস এবং স্ট্যাফাইলোকক্কি-র মতো আরো কিছু ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়, তবে এগুলোর মাত্রা ছিলো স্বাভাবিক।
দেখা গেছে দুধ উৎপাদনকারীর থেকে শুরু করে, হিমাগার এবং সবশেষে ভোক্তা অর্থাৎ স্থানীয় রেস্তোরাঁ পর্যায় পর্যন্ত দুধে ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পরীক্ষিত পাস্তুরিত দুধের নমুনার প্রায় ৭৭ শতাংশতে মোট ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা (অ্যারোবিক প্লেট কাউন্ট) উচ্চমাত্রাবিশিষ্ট, যা বিএসটিআই’এর (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) মানদণ্ডকে (≤২.০ঢ১০৪ সিএফইউ/এমএল) ছাড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে, ৩৭ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ নমুনা যথাক্রমে কলিফর্ম এবং মলবাহিত কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত ছিলো। দুধকে পানের জন্য নিরাপদ করে তোলার জন্য একে পাস্তুরিত করা হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় মানদণ্ডে পাস্তুরিত দুধে এধরনের মলবাহিত কোলিফর্মের উপস্থিতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।